মনের-জানালা

IMG1

না জানাও কি জানা ?

আমি কলেজ এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছোট থেকেই আনন্দ করতে, খেলতে , গল্প করতে, হাসতে , সকলের সাথে মিশতে আমার খুব ভালো লাগতো। স্কুল এ যখন পড়তাম তখন অনেক বন্ধু ছিল।  সবার সাথে আমি লুকোচুরি খেলতাম, লক এন্ড কী খেলতাম , দৌড়াতাম, স্পোর্টস এ পার্টিসিপেট করতাম, সব বন্ধুদের সাথে আমার অনেক ঘনিষ্টতাও ছিল।  আমি খুব ভালো বাসতাম সকলের সাথে আনন্দ করে মিশতে, মজা করতে, একসাথে পড়াশোনা করতে, কাজ করতে, দায়িত্ব নিতে। যখন আমি নবম শ্রেণী তে পড়ি তখন থেকেই আস্তে আস্তে আমি দায়িত্ব নিয়ে স্কুল এ প্রোগ্র্যাম করতাম, কাজ করতাম, বন্ধুরা সকলে মাইল দায়িত্ব সামলাতাম, মাইল মিশে পড়তাম, খেলতাম, কাজ ও করতাম। মনে আছে, যখন আমি সবে পঞ্চম শ্রেণী তখন থেকেই স্কুল এর গ্রুপ প্রজেক্ট এ আমাকে টীম লিডার করা হয়েছিল। আমার টীম এর সকল বন্ধুদের আমি কোনোদিন কোনো কাজ থেকে বাইরে রাখতাম না।  হয়তো সেই সময় থেকেই একসাথে কাজ করার অভ্যেস তৈরী হয়।  কিন্তু কলেজ এ আসার পর থেকে আমি বড্ডো এক হয়ে পড়েছি। এখানে পরিবেশ একদম অন্যরকম। হাস্তে চাইলে, খেলতে চাইলে, আনন্দ করতে চাইলে সকলে বড্ডো আমাকে নিয়ে মস্করা করে যেটা কখনো কখনো আমাকে দুঃক্ষ দায়ে। আমি এখানে মন খুলে হাস্তে পারিনা, গল্প করতে পারিনা, আনন্দ করতে পারিনা, সব কিছু থেকে এক্সক্লুড করা হয় শুধু তাই নয়, কার কতটা দায়িত্ববোধ সেইটাও বিচার্য হয় কে কতটা কনভেনশনালি সুন্দর তার উপর। ভয়ংকর একটা পরিবেশ। অন্তত আমার জন্য।  এইখানে আমার কোনো বন্ধু নেই।  ভেবেছিলাম হয়তো প্রথম কয়েক মাস এরম কষ্ট হয় তার পর আস্তে আস্তে আমি মানিয়ে নেবো। আস্তে আস্তে আমার বন্ধু হবে।  কিন্তু অদ্ভুত, এখানে বন্ধু হওয়াটা নির্ভর করে “হ্যাংআউট” সংস্কৃতির উপর। খুব অদ্ভুত বোকা বনে যাই আমি যখন দেখি ও শুনি যে আমার ব্যাচ এর প্রায় প্রত্যেকে কিসব অদ্ভুত  বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।  ওদের সাথে মেশার আগে আমি জানতামই না যে টাকা কে bucks বলে, ভিক্টোরিয়া’স সিক্রেট মডেল কি জিনিস, পার্ক স্ট্রিট এর আলোর ঝলকানিতে ওরাও থাকে , হাউস পার্টি কি জিনিস, বুজ পার্টি কাকে বলে, জাস্টিন বিবার কে, টেলর সুইফট কে, কি করে, ম্যাকারনি পাস্তা কি , আমি এদের সম্পর্কে তো কিছুই জানিনা । ওদের সুবাদে এই সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় আমার জানার সুযোগ হয়েছে তবে যেটা আমার কোনোদিন পছন্দ ছিলোনা সেটা হলো আমার না জানা ও না বোঝা কে নিয়ে ক্রমাগত হাসাহাসি করা। বারংবার আমাকে ঘিরে নানান তুলনার আড্ডা বসানো। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এ না পড়া, বাঁকুড়ার এক মফস্বলে বড়ো হওয়া, পাশা পাশি স্মার্ট না হওয়া , শহুরে আদবকায়েদায়ে উত্তর দিতে না পারা , কথা বলতে না পারা , জামা কাপড় সব কিছু নিয়ে চলতো ওদের ঠাট্টা তামাশা ও অপমান করে তুলুন করা বাকিদের সাথে। আমার কথা বলার সময় আমার জেলার কথার টান নিয়েও মজা করতো সকলে। প্রচন্ড দুঃখ পেতাম। বাড়িতে ফোন করতাম না, দোষারোপ করতাম মা বাবা ও দাদা কে আমাকে এইখানে পাঠানোর জন্য, বা ছোট থেকে আমাকে স্মার্টলি বড়ো না করার জন্য। খুব খারাপ লাগতো, কষ্ট হতো, চুপ চাপ হয়ে যেতাম, নিজেকে প্রকাশ করতাম না, এখনো করিনা। আবার কখনো কখনো মস্করা করা হতো আমার ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে। আমি যতটা হাসি খুশি, খোলা মনের মানুষ ছিলাম ঠিক ততটাই, অন্তর্মুখী, কম আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন , আরো ভীতু ও ভঙ্গুর হয়ে পড়লাম। আমার পোশাক, চেহারা, স্কুল, আমার বাড়ি নিয়েও তুলনা চলতো দীর্ঘদিন ও মাস ধরে।  একদিন এরম ক্লাস শেষের পর যখন আমরা এক জায়গায় বসে ছিলাম তখন নানান প্রসঙ্গে আমাকে বলে যে আমি যেন ওদের সাথে না মিশি কারণ ওদের গ্রুপ এ আমাকে দেখতে অনেকটা বেমানান লাগে। সেইদিন আমি কলেজ এ আর ক্লাস করিনি। মেস এ ফেরার পথে খুব কেঁদেছিলাম আর বাড়িতে ফোন করে আমি জানিয়েছিলাম যাতে আমাকে নিয়ে যায়।  তবে এখন আমি এই কথাগুলো খুব একটা মনে রাখতে চাইনা।  আমি দ্বিতীয় বর্ষে পাঠরত। মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছি। আমাকে আমার রুম মেট অনেকটা শক্তি জুগিয়েছে। আমি এখন চেষ্টা করি ভালোকরে আগের মতো আনন্দ করে সবকিছু করার আর এইসব কথায় কষ্ট না পাওয়ার।  তবে একটা প্রশ্ন বার বার মনে হয়েছে। সবাই কেন চায় যে পৃথিবীর সকলে একরকম হোক ? আমি এরম অনেক কিছুই জানিনা, বুঝিনা কিন্তু , জানতে চাই, বুঝতে চাই তবে গঠনমূলক ভাবে। এমনটা তো হতেই পারতো যে ওরা আমাকে প্রত্যেকদিন এইভাবে আন্ডারএস্টিমেট  না করে বরং আমাকে শেখাতে পারতো, গঠনমূলক উপায়ে বোঝাতে পারতো, চেনাতে পারতো। ডিসক্রিমিনেশন করা ও কাউকে আলাদা করে দেওয়া তো আমি স্কুল এ কখনো শিখিনি। নাকি ইনক্লুড করার, আলাদা করে না রাখার একটা বড় শিক্ষা ও বোধ ওরা কোনোদিন শিখে ওঠেনি ?  

   Mouli (পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক)

একটা কথাই বেজে উঠেছিল সেদিন “পড়তে হবে আমাকে আরো বেশি করে পরিশ্রম করতে হবে”। শিক্ষা টা শুধু পুঁথিগত নয়, শিক্ষাটা হলো অন্তরের আলো জ্বালানোর এক পথ। আমার দাদা সম শিক্ষক যিনি আমায় পড়িয়েছেন তিনি আমাকে শিখিয়েছেন যে নম্বরের ভিত্তিতে কখনো পড়াশোনা করতে নেই, পড়াশোনা করতে হয় মন দিয়ে। শিক্ষার কোন শেষ নেই। আমি উচ্চ মাধ্যমিকে অন্য কোনো শিক্ষক বা শিক্ষিকার কাছে পড়তাম না। আমার একজন শিক্ষকই ছিল সুতরাং বহুবিধ শিক্ষক বা শিক্ষিকার  সমাহার থাকলেই ভালো রেজাল্ট করা যায় তা কখনোই না।পড়ার আগ্রহ এবং পড়ার জেদ দুটো যদি থাকে, তাহলে সব সম্ভব।

আমি উচ্চমাধ্যমিকে 86.2শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছি ,আমার কাছে এটা অনেক যে মেয়েটা মাধ্যমিকই 53 % নম্বর পেয়েছে তার কাছে 86 এটা অনেক, আমার স্বপ্ন ছিলো মফস্বলের গণ্ডি পেরিয়ে শহরের পথে পা রাখার। বর্তমানে আমি বেথুন কলেজে ভর্তি হয়েছি এই কলেজে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম।আমি যে কলেজে পড়াশোনা করছি সেই কলেজ একটি সরকারি কলেজ অবশ্যই,এবং আমি কলা  বিভাগ নিয়েই পড়াশোনা করেছি এটা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই কারণ সবাই ভাবে যে যারা কলা  বিভাগ নিয়ে পড়ে তাদের হয়তো পড়তে হয় না। যারা বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ে তাদের মাথায় খুব চাপ থাকে এবং তাদেরই খালি পড়তে হয় এটা আমাকে বহুবার শুনতে হয়েছে। কলেজে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা সেরকমভাবে কিছু না হলেও পথেঘাটে সচেতনভাবে যাতায়াত করার আবশ্যকতা প্রতি পদক্ষেপে অনুভব করছি।  একটা মফস্বলে থাকা মেয়ে কলকাতার মতো একটা শহরে পড়তে যাচ্ছে এটা আমার মনে হয় খুব দরকার আমার শিক্ষক তাই বলেন তার জন্যই আজ আমি এখানে,এছাড়াও আমাকে অনেকে অনেকভাবে সাহায্য করেছে আজ এই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য তাদের প্রতিও আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ,আমার জীবনের সমস্ত ওঠা পড়া আমার জীবনের সমস্ত খারাপ সমস্ত ভালো সবটা হয়তো সবাই জানে না ,কিন্তু আমি জানি ওঠাপড়া না থাকলে জীবনে বড় হওয়া যায় না,এই জায়গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা খুব মনে পড়ে বেড়ার নিয়ম ভাঙ্গলে পথের নিয়ম আপনি বেরোবে।আমি জানিনা আমি বেড়ার নিয়ম কতটা ভাঙতে পেরেছি কিন্তু নিজের সমস্ত ছেড়ে আমি একটা আশা নিয়ে ই বড় হচ্ছে।যে আমি পড়াশোনা শিখব শুধু নম্বর নয় আমার জীবনের জ্ঞানটাই মূল উদ্দেশ্য মূল লক্ষ্য হবে আমি এটা অবশ্যই আশা করব। আমার আশেপাশের মানুষজন খুবই ভালো আমাকে ভীষণ উৎসাহিত করে, আমার ছোট ছোট আনন্দ খুশি ইত্যাদি দায়িত্ব রাখে আমি তাদের প্রতি খুবই আপ্লুত , আমিও চাই সবাইকে নিয়ে চলতে। কলেজে আমার কিছু নতুন বন্ধু হয়েছে ফলে আমি অনুভব করতে পারছি মফস্বলের সাথে শহুরে চালচলন আদবকায়দা পোশাক আশাক কত পার্থক্য। মতপার্থক্য কিছু ক্ষেত্রে চোখে পড়ছে। কলেজে পড়াশোনার ধরনটাও অনেকটাই আলাদা। কলেজে যেভাবে পড়ানো হয় সেটা মনযোগ দিয়ে শুনলে আর পরবর্তীকালে পড়তে হয় না। আমার দেড়-মাসের কলেজ জীবনে এইটুকুই আমার অভিজ্ঞতা।

 

 

Name- Priti Patra
Age- 17
Class- BA SEM 1
Institution– Bethune College

 

Open chat
1
How Can I Help You
How Can I Help You